‘মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি।
‘মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি।
আমি নিজেকে আর আটকিয়ে রাখতে পারলাম না। স্যরি আবুজান। তোমার কথা অমান্য কোরে বের হোলাম। স্বার্থপরের মতো ঘরে বোসে থাকতে পারলাম না। আমাদের ভাইরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে রাজপথে নেমে সংগ্রাম কোরে যাচ্ছে। অকাতরে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিচ্ছে।
একটি প্রতিবন্ধী কিশোর, ৭ বছরের বাচ্চা, ল্যাংড়া মানুষ যদি সংগ্রামে নামতে পারে, তাহলে আমি কেনো বোসে থাকবো ঘরে। একদিন তো মরতে হবেই। তাই মৃত্যুর ভয় কোরে স্বার্থপরের মতো ঘরে বোসে না থেকে সংগ্রামে নেমে গুলি খেয়ে বীরের মতো মৃত্যু অধিক শ্রেষ্ঠ। যে অন্যের জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেয়, সে-ই প্রকৃত মানুষ। আমি যদি বেঁচে না ফিরি, তবে কষ্ট না পেয়ে গর্বিত হয়ো। জীবনের প্রতিটি ভুলের জন্য ক্ষমা চাই।’
৫ আগস্ট কাঁপা হাতে ভুল বানানে মায়ের উদ্দেশে এই চিঠি লিখে লংমার্চ টু ঢাকার উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হন আদর্শ একাডেমির ছাত্র শাহরিয়ার খান আনাস। আর পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়ে বরণ করেন বীরের মতো শ্রেষ্ঠ মৃত্যু।
ঢাকার গেণ্ডারিয়ার বাসিন্দা শাহরিয়ার খান আনাস ছিলেন ১৬ বছরের কিশোর। সবেমাত্র দশম শ্রেণিতে পড়তেন। এ বয়সেই দেশের জন্য, মুক্তির জন্য, দেশের মানুষের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে দ্বিধাবোধ করেননি। আর দশটা সাধারণ পরিবারের মতো ছোট ছিমছাম এক পরিবারে আনাসের বেড়ে ওঠা। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন।
পরিবারের সবার চোখের মণি আনাস ভীষণ সহজ-সরল, ধর্মভীরু এবং বুঝদার ছিলেন। তার দাদি মারা যাওয়ার পর দাদির জায়নামাজ চেয়েছিলেন আবদার করে। সেই জায়নামাজে রোজ নামাজ পড়তেন। ছোট ভাইদের ছাড়া কখনো কিছুই খেতেন না। কিছু দরকার হলে বাবার কাছে বায়না করতেন না কখনো। জিজ্ঞেস করতেন, বাবা তুমি কি আমাকে একটা জিনিস দিতে পারবে?
সন্তানকে ছোট থেকে ভীষণ যত্নে সুশিক্ষা দিয়ে বড় করেছেন মা সানজিদা। কখনো ছেলেকে খেলনা হিসেবে পিস্তল কিনে দেননি, যাতে ছেলে কখনো আক্রমণাত্মক না হয়। যখন আন্দোলন শুরু হয়, ছেলে বারবার বাবা-মায়ের কাছে এসে এটা-ওটা জানতে চাইত। বাবা-মা চাইতেন ছেলেকে সহিংসতা থেকে দূরে রাখতে। বুঝিয়েছিলেন এই আন্দোলনের সঙ্গে তাদের কোনো লেনাদেনা নেই।
কিন্তু যেদিন ছাত্রদের বুকে গুলি চলল, সেদিন থেকে কিছুতেই আর কারো মন ভালো নেই। এরপর দিন দিন পরিস্থিতি কেবল খারাপই হয়েছে। আনাস বাবার কাছে বায়না করে আন্দোলনে যাওয়ার। বাবা তাকে আশ্বাস দেন, তিনি ছেলেকে আন্দোলনে নিয়ে যাবেন। তবে সাহস পান না লাশের স্তূপ দেখে।
সমন্বয়কদের যেদিন ডিবিতে আটকে রাখা হয়, সে বাবার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে সমন্বয়ক কী? আরও নানা প্রশ্ন করে। বাবা ছেলের সব প্রশ্নের উত্তর দেন। ছেলের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখ দেখে তাকে পড়তে বসতে বলেন। সে বই-খাতা খুলে পড়ার অভিনয় করলেও তার মাথায় ঘুরছিল আন্দোলন ও তার ভাইদের মৃত্যু।
বাবা-মাকে মিছিমিছি পড়ছে দেখালেও খাতা ভর্তি করে সে লিখেছে তার চোখে দেখা জুলাই। ৪ আগস্ট সমন্বয়কদের প্রত্যেক ঘর থেকে একজন করে লংমার্চে যোগ দেওয়ার আহ্বান শুনে বাবার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, বাবা এই কথা কেন বলা হলো? পাশ থেকে মা উত্তর দেন, সারা দেশের মানুষের পক্ষে তো ঢাকা আসা সম্ভব নয়, তাই তারা অন্তত একজন করে হলেও প্রতিনিধি পাঠাতে বলেছে। তখন সে বাবার কাছে অনুনয় করে লংমার্চে যাওয়ার।
বাবা আশ্বাস দেন, গেলে পরিবারের সবাই একসঙ্গে যাবেন, একসঙ্গে শহীদ হবেন। বাবার কথায় ভরসা পান না আনাস। সিদ্ধান্ত নেন একাই যাবেন। বাড়িতে অব্যবহৃত একটি ফোনে সিম কানেক্ট করে একটি চিঠি লেখেন মায়ের উদ্দেশে।
৫ আগস্ট সকালে কেউ ঘুম থেকে ওঠার আগেই বেরিয়ে পড়ে মিছিলে যোগ দেন। সকালে সন্তানকে দেখতে না পেয়ে এবং চিঠি পড়ে মায়ের মন উতলা হয়ে ওঠে। দৌড়ে গিয়ে আনাসের বাবার কাছে বিষয়টি জানান। আনাসের বাবা নির্বিকার হয়ে বলেন, আমার সন্তানকে আমি আল্লাহর হেফাজতে ছেড়ে দিয়েছি।
আনাস কাউকে চিনতেন না, জানতেন না। আন্দোলনরত অবস্থায় অনেকের সঙ্গে পরিচিত হন। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মাঝে একপর্যায়ে তার মাথায় রাবার বুলেট এসে লাগে। ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে বাকিদের জিজ্ঞেস করেন, এতে কি আমার কিছু হবে? আমি কি মরে যাব? বাকিরা তাকে অভয় দেন, রাবার বুলেটে কিছু হয় না।
তিনি তখন বাকিদের বলেন, আমার যদি গুলি লাগে আমি যেন একেবারেই মরে যাই, আহত হয়ে পরিবারের বোঝা না হই। এর কিছুক্ষণ পরই আনাসের বুকে এসে লাগে গুলি। এ পাশ থেকে ও পাশ ফুঁড়ে বেরিয়ে যাওয়া গুলি কেড়ে নেয় আনাসের জীবন। নির্বিকার রাস্তায় পড়ে থাকে আনাসের লাশ।
আন্দোলনকারীরা তবুও আশা নিয়ে তাকে মিটফোর্ট হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে ডাক্তার জানান আনাস আর বেঁচে নেই। এর মাঝে পুলিশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বারবার তার লাশ সরিয়ে ফেলতে চেষ্টা করছিল। লাশ গুম করার আশঙ্কায় তাকে আগলে রাখেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সৌরভ। আনাসের পকেটে পাওয়া ফোন থেকে বাড়িতে ফোন করে জানান আনাসের খবর এবং পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেন লাশ।
৫ তারিখের অমন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে আনাসের বাবা-মা ছেলের লাশ নিয়ে ফেরার জন্য একটা গাড়ি পাচ্ছিলেন না কোথাও। একটি রিকশায় ছেলের লাশ বুকে ধরে বাড়ি নিয়ে আসেন। তাকে গোসল করাতে দেয়নি এলাকাবাসী, কারণ শহীদের কোনো গোসলের প্রয়োজন হয় না। শহীদ আনাসের জন্য নিজের ইহরামের কাপড় দিয়ে দেন একজন।
সেভাবেই তার রক্তমাখা শরীর দাফন করা হয়। এলাকাবাসী আনাসের স্মরণে দীননাথ রোডের নতুন নামকরণ করেছে শহীদ আনাস সড়ক নামে। এখন সবাই চান সিটি কর্পোরেশন সরকারিভাবে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করুক।
সন্তানকে হারিয়ে জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে আছেন আনাসের বাবা-মা। আনাসের ছোট ভাইয়েরা রাস্তায় ব্যানারে ছবি দেখে ভাবে- ভাই আছে রাস্তায়, ফিরে আসবে বাসায়। তাই ভাইয়ের রুমের কোনো জিনিসে হাত দেয় না, পাছে ভাই এসে বকা দেয়! অথচ তাদের ভাই বকা দেওয়ার জন্য আর কোনোদিন ফিরতে পারবেন না।
Comments 0